তাজহাট জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা মান্না লাল রায়। তিনি পাঞ্জাব থেকে এসে রংপুরের মাহীগঞ্জে বসবাস শুরু করেন। সে সময় মাহীগঞ্জ ছিল রংপুরের জেলা শহর। এ রকম গল্প প্রচলিত আছে, স্বর্ণ ব্যবসায়ী মান্না লাল রায়ের আকর্ষণীয় 'তাজ' আর 'রত্ন'খচিত মুকুটের কারণে এ এলাকার নামকরণ হয় তাজহাট।
জীবদ্দশায় তিনি বিপুল পরিমাণ ভূসম্পত্তির মালিক হন। রংপুরের অনেক এলাকা তার আয়ত্তে আসে। বংশপরম্পরায় মান্না লাল রায়ের নাতি ধনপতি লাল জমিদার হন। ধনপতি রায়ের নাতি উপেন্দ্র লাল রায় জমিদারি গ্রহণের পর অল্প বয়সে মারা যান। তখন জমিদারির দায়িত্ব তার কাকা 'মুনসেফ' গিরিধারী লাল রায়ের হাতে আসে। তিনি নিঃসন্তান হওয়ার কারণে কলকাতার গোবিন্দ লালকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন। গোবিন্দ লাল ১৮৭৯ সালে এই জমিদারির উত্তরাধিকারী হন। পরে তিনি ১৮৮৫ সালে রাজা, ১৮৯২ সালে রাজাবাহাদুর এবং ১৮৯৬ সালে মহারাজা উপাধি লাভ করেন। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে নিজ বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে তিনি মারা যান। ১৯০৮ সালে তার ছেলে মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় জমিদারির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় রাজবাড়ির মালপত্র গুছিয়ে ট্রেনে ভারতে যাওয়ার সময় কুষ্টিয়ায় হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ছেলেমেয়েরা তার লাশ ও মালপত্র নিয়ে ভারতে চলে যান। এখন রাজবাড়িতে জমিদার আমলের কাঠের একটি টেবিল-চেয়ার ও ঝাড়বাতির অংশ আছে কালের সাক্ষী হয়ে।দায়িত্ব গ্রহণের পর বর্তমান ভবনটির নির্মাণ শুরু হয়। দক্ষ নকশাকার ছাড়াও সব মিলিয়ে কাজ করেন প্রায় দুই হাজার রাজমিস্ত্রী। ১৯১৭ সালে ভবনটি সম্পূর্ণ হয় এবং সে সময়ের হিসেবে এতে খরচ হয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। ইতালি থেকে আমদানিকৃত শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এ বাড়ির সম্মুখ সিঁড়িটি। এছাড়া ভবনের প্রধান প্রধান অংশ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় লাল ইট, শ্বেতপাথর ও চুনাপাথর। পুরো ভবনটিতে রয়েছে ২৮টি কক্ষ। ভবনের সামনে মার্বেল পাথরের সুদৃশ্য একটি ফোয়ারা আজো বিদ্যমান। ঢাকার আহ্ছান মঞ্জিলের মতো দেখতে এ জমিদার বাড়ির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় রয়েছে রাজা গোপালের ব্যবহূত নানা জিনিস। ১৯৫২ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পরে এ বাড়ি চলে যায় কৃষি বিভাগের অধীনে এবং এখানে গড়ে ওঠে কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ বাড়ির প্রচুর মূল্যবান সম্পদ খোয়া যায়। ১৯৮৫ সালে এখানে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ চালু হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে তাজহাট জমিদার বাড়ি রূপান্তর করা হয় জাদুঘরে। আর এর নাম রংপুর জাদুঘর। এ জাদুঘরে ৩০০টি মূল্যবান নিদর্শন রয়েছে।
দোতলার সংগ্রহশালায় দুই হাজার বছরের পুরনো ছাদ, 'কচিকা পাথর'। বেগম রোকেয়ার চিঠি, তুলট কাগজে লেখা সংস্কৃত হস্তলিপি, পাঁচ কালেমার শাহাদাত উত্কীর্ণ আরবি শিলালিপি, ৬৯ হিজরির পোড়ামাটির লিপি, ১২০০ খ্রিস্টাব্দের শিলালিপি, ১৬৯১ সালের কালো পাথরের সংস্কৃতি শিলালিপি, এক দশমিক ৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, এক ইঞ্চি প্রস্থ ও আধা ইঞ্চি পুরো কোরআন শরিফ, পোড়ামাটির সীলমোহর, মাটির পাত্র, বৃহত্ হাতির দাঁত ও হাতির দাঁতের পাশা, বিভিন্ন আকার ও সময়ের অনেক বিষ্ণুমূর্তিসহ নিদর্শন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন